ষোড়শো পচারে দুর্গাপুজো সারতে যে সামগ্রীগুলো ব্যবহার করা হয় , তার কোনোটারই ভিত্তিহীনভাবে পূজোয় অন্তর্ভুক্ত হয়নি , পঞ্চশস্য থেকে দশমৃতিকা-যা কিছু ব্যবহার করা হয় দুর্গাপূজায় ,তার মধ্যে সামাজিক অবস্থা ও বিজ্ঞান মানসিকতা এবং পুজোয় সবার অংশগ্রহণের ছাপ পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন পুরান বিশারদরা ।
Nepal Bhattacharya Street Pic Courtesy DEV Photography |
দুর্গাপুজো আদতে 'শাকম্ভরী' মূর্তিকল্পনার আড়ালে নবপত্রিকার পুজো । কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনের পর্বে শস্যদায়িনী পৃথিবীমাতার আরাধনাই প্রকৃতপক্ষে নবপত্রিকার পুজো । বাংলার দুর্গাপুজোয় এই 'নবপত্রিকা'-কে 'কলা বৌ' রূপে পূজা করা হয়। পুরাণসূত্র অনুসারে দেবীর ৯টি রূপ এবং সেগুলির প্রতিক হিসাবে ৯টি বিভিন্ন গাছের ডাল বা অংশ নিয়ে গড়া হয় 'নবপত্রিকা' । এতে লাগে- কলাগাছ ,কালোকচু, মানকচু, হলুদ, জয়ন্তী,বেল, ডালিম, অশোক ও ধান ।এগুলি শ্বেত অপরাজিতার লতা ও হলুদ রঙের সুতো দিয়ে বেঁধে তৈরি হয় 'নবপত্রিকা'।এই বিভিন্ন গাছ বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতীক । যেমন- কলাগাছ ব্রাহ্মণীর প্রতীক
কালোকচু কালিকার প্রতীক
মানকচু চামুন্ডার প্রতীক
হলুদ দুর্গার প্রতীক
জয়ন্তী কার্তিকীর প্রতীক
বেল শিব/শিবানীর প্রতীক
ডালিম রক্তদন্তিকার প্রতীক
অশোক শোকরহিতার প্রতীক
ধান লক্ষ্মীর প্রতীক
মহাসপ্তমী সকালে অনুষ্ঠিত হয় 'কলা-বৌ' বা 'নবপত্রিকা' স্নান পর্ব। এই স্নানের জন্য লাগে তেল,হলুদ, মাথাঘষা ,অষ্টকলস,পঞ্চরত্নের জল, পঞ্চামৃত,পঞ্চশস্য ,পঞ্চগব্য,পঞ্চকষায় ,বৃষ্টিরজল ,শিশিরের জল,ডাবের জল,উষ্ণজল ,সমুদ্রের জল,তীর্থের জল,আখের রস,পদ্মরেণু রস,সবৌষধি ,মহৌষধি,বরাহমৃত্তিকা,বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা ,চতুষ্পথ মৃত্তিকা, অগুরু,চন্দন, ফুলনতেল।এই উপাচারে 'নবপত্রিকা' বা 'কলা-বৌ' স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরিয়ে গণেশের পাশে স্থাপন করা হয়, যার অন্য নাম 'পুষ্টি'।
প্রকৃত পূজার সূচনা মহাসপ্তমী থেকে ওই দিন সকালে স্নান এর পরে যথাবিহিত নৈবিত্তিক উপহার সাজিয়ে আরম্ভ হয় পুজো। হিন্দু বিশেষ করে, বাঙালি হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস অনুসারে বলা হয় যে; দূর্গা পূজোয় দেবী দুর্গার সঙ্গে তার দুই কন্যা সরস্বতী-লক্ষী এবং কার্তিক-গণেশও মর্ত্যে আসেন পুজো গ্রহণ করতে ।তাই দুর্গা পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য আলাদা আলাদা থালায় নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো করতে হয় । এমনকি বাদ পড়ে না মহিষাসুর এবং সিংহও, পুজো শেষ পর্বে থাকবে মঙ্গলারতি ।
Falguni Sangha Pic Courtesy DEV Photography |
তথ্যসূত্র - সুমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুবলয় বন্দ্যোপাধ্যায়
বিন্যাস: অরিন্দম মজুমদার
দশপ্রহরণ
মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে দেবতাদের মিলিত তেজঃপুঞ্জ থেকে উদ্ভূত দেবী দশভুজার হস্ত দেবতারা বিবিধ অস্ত্রে সজ্জিত করলেন।
পবনদেব দেবীকে দিলেন ধনু ও বানপূর্ন তূনীর
যম তাঁর কালদন্ড থেকে উৎপন্ন দন্ড দেবীকে দিলেন
মহাদেব তাঁর শূল থেকে উৎপন্ন ত্রিশূল দেবীকে দিলেন
বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র থেকে উৎপন্ন চক্র দেবীকে দিলেন
জলদেবতা বরুণদেব দেবীকে দিলেন একটি পবিত্র শঙ্খ
সমুদ্র দেবীর মস্তকে পদ্মমালা ও হাতে একটি পদ্ম দিলেন
কাল দেবীকে দিলেন একটি প্রদীপ্ত খড়্গ
ইন্দ্র তাঁর বজ্র থেকে উৎপন্ন বজ্রান্তর দেবীকে দিলেন
বিশ্বকর্মা দেবীকে দিলেন একটি অত্যুজ্জ্বল কুঠার
নাগরাজ বাসুকী দেবীকে মণিশোভিত নাগহার দিলেন
পঞ্চশস্য তিল-ধান-সাদাসর্ষে-মুগকলাই-যব
পঞ্চামৃত দুধ-দই-ঘি-মধু-চিনি
পঞ্চকষায় জাম-শিমুল-বট-কুল-বকুল
পঞ্চদেবতা সূর্য-গণেশ-দুর্গা-বিষ্ণু-শিব
পঞ্চপল্লব আম-অশ্বথ-বট-যজ্ঞডুমুর-বকুল
পঞ্চগব্য দই-দুধ-ঘি-গোমূএ-গোময়
পঞ্চরং তুষ পোড়া (কালো) ,বেলপাতা চূর্ণ (সবুজ), হলুদ, আতপ চাল গুড়ো (সাদা), পলাশ ফুল ভিন্নমতে সিঁদুর (লাল)
নবপত্রিকা কলা,ডালিম,ধান, হলুদ, মান,কচু,বেল,অশোক, জয়ন্তী
নবগ্রহ সূর্য, চন্দ্র, বুধ, মঙ্গল ,শুক্র ,বৃহস্পতি ,শনি ,রাহু ,কেতু
Suruchi Sangha Pic Courtesy DEV Photography |
দশমৃত্তিকা
নদীর উভয় কুলের মাটি, বৃষশৃঙ্গের মাটি , গজদন্ত মৃত্তিকা , বরাহদন্ত মৃত্তিকা, পর্বতশৃঙ্গ মৃত্তিকা, চতুষ্পথ মৃত্তিকা, রাজদ্বার মৃত্তিকা, উইঢিবির মাটি,বেশ্যাগৃহের মাটি ও গঙ্গাঁ মাটি
১০ রকমের মাটি - দেশের সব প্রান্তকে এক করে পুজো করার প্রতীক
নদীর দুই পাড়ের মাটি সঙ্গে গজদন্তের মাটি এবং রাজদ্বারের মাটির সঙ্গে বেশ্যাগৃহের মাটি মিশিয়ে বোঝানো হয়, "কেউ ব্রাত্য নয় ,সবার যোগদান রয়েছে ।"
( এ বিষয়ে একাধিক মত আছে। অনেকে মনে করেন দশ নয়, শুরুতে ৭ রকমের মাটির ব্যবহার ছিল। পরে পরিবর্তিত হয়ে ১০ হয়েছে )
নবদুর্গা
হিন্দু পুরাণ শাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ একেই বলা হয় নবদুর্গা । 'প্রতিপদাদিকল্প'র পুজোয় দেবী দুর্গাকে পুজোর ৯ রাত্রি ৯ টি ভিন্ন দেবী রূপে পূজা করা হয় ।
Ballygunge Cultural Association Pic Courtesy DEV Photography |
শৈলপুত্রী দেবী দুর্গা প্রতিপদে গিরিরাজ হিমালয় কন্যা দেবী শৈলপুত্রী হিসেবে পূজিত হন। নবদুর্গার প্রথম রূপ 'শৈলপুত্রী' নামের অর্থ 'পর্বতের কন্যা '
ব্রহ্মচারিণী দেবী দুর্গা দ্বিতীয়ায় তপশ্চারিনী দেবী ব্রহ্মচারিণী হিসেবে পূজিত হন। ব্রহ্মচারিণী নামের অর্থ যিনি ব্রহ্মচর্য ব্রত অবলম্বন করেন
চন্দ্রঘণ্টা দেবী দুর্গার তৃতীয়ায় শান্তি ও কল্যাণের দেবী চন্দ্রঘন্টা হিসাবে পূজিতা হন ।মস্তকে থাকা ঘন্টাকৃতি অর্ধচন্দ্রের জন্য নাম চন্দ্রঘণ্টা
কুষ্মান্ডা দেবী দুর্গার চতুর্থীতে ব্রহ্মান্তে উৎপন্নকারিনী দেবী কুষ্মান্ডা হিসেবে পূজিত হন।দেবী দুঃখ গ্রাস করে ধারণ করেন তাই কুষ্মান্ডা নাম
স্কন্দমাতা দেবী দুর্গা পঞ্চমীতে কুমার কার্তিকের মাতা দেবী স্কন্দমাতা হিসেবে পূজিত হন। কার্তিকের অপর নাম স্কন্দ তার মা বলে তিনি স্কন্দমাতা
কাত্যায়নী দেবী দুর্গা ষষ্ঠীতে কাত্যায়নের কন্যা দেবী কাত্যায়নী হিসেবে পূজিত হন। কাত্যায়নী আজ্ঞা চক্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী
কাল রাত্রি দেবী দুর্গার সপ্তমীতে দুষ্টের দমনকারী দেবী কালরাত্রি হিসেবে পূজিত হন। ভীষণ-দর্শনা এই দেবীর গাত্র রং ঘন অন্ধকারের মতো কালো।
মহাগৌরী দেবী দুর্গা অষ্টমীতে মহাদেবপত্নী দেবী মহাগৌরী হিসেবে পূজিত হন। তিনি শ্বেতবর্ণা শ্বেতবস্ত্রাবৃতা অলংকারও শ্বেতবর্ণের
সিদ্ধিদাত্রী দেবী দুর্গার নবমীতে সর্বসিদ্ধি পদায়িনী দেবী সিদ্ধিদাত্রী হিসেবে পূজিত হন। স্বর্ণবর্ণা রক্তবস্ত্রধারিনী চতুর্ভুজা দেবীর চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম
তথ্যসূত্র - নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ি ( পুরাণবিশারদ )
জয়ন্তী কুশারী (সর্বভারতীয় প্রাচ্যবিদ্যা অ্যাকাডেমি)
রঞ্জন পাঠক (উওর কলকাতা ব্রাহ্মণ সমাজ)
Comments
Post a Comment